বিয়ের আগে যে কথাগুলো বলা উচিত

বিয়ের আগে যে কথাগুলো বলা উচিত -১

বিয়ে মানুষের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। সবারই বিয়ে নিয়ে থাকে নানা জল্পনা-কল্পনা। আসলে আমরা স্বপ্ন দেখি অনেক। কিন্তু স্বপ্নের সাথে বাস্তবতাটাও ভাবা জরুরী। অনেক সময় দুইয়ে দুইয়ে চার নাও হতে পারে। যেহেতু সম্পর্কটা সারাজীবনের এবং অনেক কিছুই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই বাস্তবতার নিড়িখে স্বামী-স্ত্রীর সমঝোতার মাধ্যমে অনেক অনাকাংখিত ব্যাপার ঘটা রোধ করা যায়। এজন্য বিয়ের আগেই কিছু বিষয় আছে যা দুজনের মধ্যে আলোচনা করে নেয়া উচিত। যা পরবর্তী জীবনকে অনেকটাই সহজতর করবে।
১. সন্তান

বিয়ে করার ক্ষেত্রে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা খুবই স্বাভাবিক এবং জরুরী। বিয়ে মানে একটি পরিবার শুরু করা, আর সেই পরিবার হলো সন্তানদেরকে নিয়েই। এজন্য একটি সংসার শুরু করার আগেই সঙ্গীর সাথে আলোচনা করে নেয়া উচিত আপনারা কয়টি সন্তান নিতে চান বা তাদের কিভাবে বড় করে তুলবেন। মনে রাখবেন প্ল্যানিং ছাড়া সন্তান নিলে ভবিষ্যতে আপনাদের সাথে সাথে তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
২. অর্থ

কেউ মানুক চাই না মানুক, জীবনে চলতে গেলে অর্থ বা টাকা-পয়সা অস্বীকার করা যাবে না। এজন্য সঙ্গীর সাথে এটিও আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই আলোচনার মানে এই নয় যে, স্ত্রী চাইবে স্বামী যে করেই হোক বেশি টাকা রোজগার করবে। আপনার পরিবারের আয় যতোই হোক এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরী। এজন্য দুইজনের একটা জয়েন্ট ব্যাংক একাউন্ট করে নেয় দরকার। আরো কিছু বিষয় স্পষ্ট করা দরকার যে, প্রতি মাসে বিলের টাকা গুলো কে পরিশোধ করতে যাবে, কতো টাকা সঞ্চয় করতে হবে ইত্যাদি।
৩. পরিবার

একটি বিয়ের মাধ্যমে দুইটি মানুষের সাথে সাথে দুইটি পরিবারেরও বন্ধন তৈরী হয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনের পরিবারের মধ্যেই অনেক সমস্যা থাকতে পারে। এজন্য আগেই দুজনে ঠিক করে নেয়া উচিত একে অন্যের পরিবারের সাথে আচরণ কেমন হবে। হয়তো একজনের আরেকজনের পরিবারকে ভাল নাও লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে একে অন্যের পরিবারের প্রতি যে কর্তব্য সেগুলো যেন খর্ব না হয় এ ব্যাপারে আলোচনা করে নেবেন।
৪. লক্ষ্য ঠিক করুন

একটি সংসার যেহেতু দুইটি মানুষের সমন্বয়ে গঠিত, তাই দুজনেরই আলাদা আলাদা লক্ষ্য থাকতে পারে। এবং সেই লক্ষ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ থাকতে পারে। আপনি যদি ক্যারিয়ার মাইন্ডের হন তাহলে আগামী পাঁচ বছরের জন্য লক্ষ্য ঠিক করুন। আপনার ক্যারিয়ার এবং পরিবার এদুটি সমান্তরালে রাখতে গেলে আপনার সঙ্গীরও যথেষ্ট সহয়োগীতা প্রয়োজন। এজন্য তাকে নিয়েই একটি লক্ষ্য ঠিক করে নেয়াই হবে বুদ্ধির কাজ।
৫. যেখানে থাকবেন

বিয়ের পর আপনি কোথায় থাকতে যাচ্ছেন? একক পরিবারে নাকি যৌথ পরিবারে? দুই ক্ষেত্রেই আগেভাগে আলোচনা করে নিতে হবে। একক পরিবারে থাকলে দায়িত্ব ভাগাভাগী করে নেয়ার একটি ব্যাপার থাকে। আর যৌথ পরিবারে আপনার ভূমিকা কি হবে, অন্যদের সাথে সম্পর্ক এবং দায়িত্ববোধ কতটুকু হবে এটি আপনার একার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এই ব্যাপারে আলোচনা করলে আপনি যে সঙ্গীর পরিবারকে সম্মানের চোখে দেখছেন এটিও তার কাছে প্রতিয়মান হবে।
৬. বেড়াতে যাওয়া

আপনার সঙ্গী হয়তো বেড়াতে যেতে পছন্দ নাও করতে পারে। কিন্তু মাঝে মাঝে বিভিন্ন ছুটির সময় দুজন মিলে কোথাও বেড়িয়ে আসলে, নিজেদের একান্ত কিছু সময় যে উপভোগ করা যায় এটি তার কাছে তুলে ধরতে হবে। বিয়ের পর মানসিক চাপ কমাতে একটু ঘুড়তে যাওয়া ব্যাপক সাহায্য করে।
৭. ধর্মীয় অনুশাসন

ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যপারে আলাপ-আলোচনা বিয়ের আগে সঙ্গী-সঙ্গিনীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দুইজন দুইরকম পরিবেশে বড় হয়েছেন। দুই পরিবেশে ধর্মীয় অনুশাসন দুরকম হতে পারে। যেমন হয়তো কেউ খুব রক্ষণশীল পরিবেশে বড় হয়েছেন, আবার কেউ উদার পরিবেশে। এই ক্ষেত্রে দুজনকেই একটি সমঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানে থাকা জরুরী। বেশি কট্টরও না, আবার বেশি উদারও না। কারণ যেহেতু দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক, একজন আরেকজনের উপর কিছু চাপিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
৮. পূর্ব সম্পর্ক

যদিও বিয়ের শুরুতেই এ ব্যাপারে আলোচনা করাটা একটু বিব্রতকর। তবুও যদি কারো কোন পূর্ব সম্পর্ক থেকে থাকে তা বলে নেয়াই ভাল। কারণ একটা কথা মনে রাখবেন সত্য কোনদিন চাপা থাকে না। কোন না কোন দিন এই কথা প্রকাশ পাবেই। তখন পরিণতি আরো ভয়াবহ হবে, অনেকটা সাজানো বাগান ধ্বংসের মতো। এ ক্ষেত্রে আপনাকে বোঝাতে হবে যে আগের সবকিছুর পাট চুকিয়ে আপনি এই সম্পর্কটাকে মুখ্য রেখে আপনার জীবন সাজিয়েছেন। প্রথমে একটু সমস্যা হলেও পরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
৯. গোপন কথা

সব মানুষের ভেতরই এমন কিছু গোপন বিষয় থাকে যা তা সে ছাড়া আর কেউ জানেনা। এখানে দুইটি বিষয় আছে যদি আপনি এই গোপন বিষয়টি সঙ্গীর কাছ থেকে এড়িয়ে যেতে না পারেন তাহলে তা তাকে জানিয়ে দেয়াই শ্রেয়। আর যদি এড়াতে পারেন বা সারা জীবন এটি বাদ দিয়ে চলতে পারেন তাহলে না বলাই ভাল। এক্ষেত্রে আপনাকে দেখতে হবে যে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে কতটুকু বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
১০. বিশ্বস্ততা

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বস্ততা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে শুরু থেকেই একে অপরকে ভালবাসতে হবে, আর সেই ভালবাসা হবে শর্তহীন ভালবাসা। প্রতিটি কাজেই একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকাটা যে সবদিক দিয়েই জরুরী তা তুলে ধরুন। এমন অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয় আছে যেগুলো আমরা লুকাতে গিয়ে একে অন্যের বিশ্বস্ততা হারিয়ে ফেলি। মনে রাখবেন বিশ্বস্ততা একবার নষ্ট হলে তা ফিরে পাওয়া অনেক কঠিন ব্যপার।

বিয়ের আগে যে কথাগুলো বলা উচিত -২

বিয়ের আগে আপনার সারাজীবনের সঙ্গীটির সাথে কিছু কথা না বললে হয়তে দুজন দুজনার অনেক কিছুই অজানা রয়ে যেতে পারে। যেহেতু সম্পর্কটা সারা জীবনের তাই দুদিক থেকেই স্বচ্ছ থাকা প্রয়োজন। আজ গত পর্বের ধারাবাহিকতায় সেসব কথা নিয়ে শেষ পর্ব।
১১. মূল্যবোধ

প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু মূল্যবোধ থাকে। যদিও বেশিরভাগ মূল্যবোধে খুব একটা পার্থক্য থাকেনা। তবে যে বিষয়টি আলোচনা করা দরকার তা হলো প্রত্যেকের গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধগুলোকে সম্মান প্রদর্শন করা এবং কোনগুলো আপনারা পারিবারিক ভাবে পালন করবেন।
১২. ভালবাসার প্রকাশ

আমারা প্রত্যেকে ভালবাসা গ্রহন করি ভিন্নভাবে। কেউ কেউ ভালবাসা অনুভব করে আপনি যদি তাকে সবসময় ভালবাসার কথা বলেন। আবার কেউ আছে আপনার কর্মকান্ডে ভালবাসা খুজে নিতে পছন্দ করে। দুজনের ভালবাসার এই দিকটি শুরুতেই খুজে বের করতে হবে।
১৩. ঘরের কাজ

এখন আর আগের অবস্থা নেই যে স্বামী সারাদিন কাজকর্ম করে বাসায় ফিরবে আর স্ত্রী বাসার কাজ সামলাতেই সারাদিন পার করবে। যদিও সবকিছুর পরেও ঘর সামলানোর বড় দায়িত্বটা স্ত্রীর কাঁধেই রয়ে যায়। তারপরও অনেক দায়িত্ব আছে যেগুলো শেয়ার করে নিলে দুজনের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি পায়।
১৪. বাজেট

শুধু অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করাই যথেষ্ট নয়। আপনাদের প্রতিটি কাজ করতে হবে একটি বাজেটের মাধ্যমে। আয়ের সাথে সংগতি রেখে ঠিক করতে হবে প্রতি মাসের বিভিন্ন খাতের খরচ। এটি করতে পারলে সাংসারিক অনেক তুচ্ছ কলহ সহজেই দূর করা যায়।
১৫. আবসর সময়

আমরা একেক জন একেক ভাবে অবসর সময় কাটাতে পছন্দ করি। কেউ বই পড়ে, কেউ টিভি দেখে কেউবা সৃষ্টিশীল কোন কাজে। কেউ যাতে কারো অবসর সময় কাটানোর ভঙ্গি দেখে বিরক্তবোধ না করে, সেজন্য এমন কোন পদ্ধতি খুজে নিতে হবে যাতে তা দুজনের জন্যই রুচিসম্মত হয়।
১৬. মাতা-পিতা হিসাবে ভূমিকা

সন্তান লালন-পালনে মা-বাবা হিসাবে আপনাদের ভূমিকা কেমন হবে এটিও ঠিক করে নেয়া জরুরী। এক্ষেত্রে কেউ রক্ষণশীল ভাবে আবার কেউ উদারভাবে সন্তান পালনে বিশ্বাসী। এখানে কোন পদ্ধতি ভালো বা কোনটি খারাপ এই বিষয়টি মুখ্য নয়। যাতে সন্তানদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরী না হয় তাই আগেভাগেই এটি ঠিক করে নেয়া উচিত।
১৭. ঝগড়া করবেন কিভাবে

সংসারে একটু ঝগড়া-ঝাটি, মান-অভিমান হতেই পারে। তবে যাতে সেই ঝগড়া-ঝাটি নোংরামিতে পরিণত না হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। স্বামী-স্ত্রী হিসাবে কার মন খারাপ থাকলে সে কেমন আচরণ করবে তা সম্পর্কে আগে থেকেই ধারনা নিয়ে রাখতে হবে।
১৮. ক্ষমা করার পদ্ধতি

কোন মন-মালিন্যের পর আপনারা কিভাবে একজন আরেকজনকে ক্ষমা করবেন? আপনি কি জানেন আপনার সঙ্গী কোন কাজটিকে ক্ষমার অযোগ্য মনে করে? এই ব্যাপারগুলো জেনে রাখা সাংসারিক জীবনকে অনেক সহজতর করতে পারে।
১৯. বিশ্বাস

আপনারা কি একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করেন? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে সম্পর্ক কিন্তু বিশ্বাসের ওপরই গড়ে ওঠে। সম্পর্ক শুরুর আগেই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঝামেলাগুলো মিটিয়ে ফেলুন। মনে রাখবেন অবিশ্বাসের বীজ পুষে রাখলে তা একসময় বিষবৃক্ষে পরিণত হতে পারে।
২০. হিংসাকে এড়িয়ে চলা

হিংসা যে কোন সম্পর্ককে অবনতির দিকে নিয়ে যেতে বড় ভূমিকা পালন করে। মানুষ হিসাবে আমরা কোনকিছুরই উর্ধ্বে নই। এজন্য বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে আমাদের হিংসা হতেই পারে। যেমন স্বামী যদি স্ত্রীর কাছে অন্য কোন নারীর প্রশংসা করে কিংবা স্ত্রী যদি স্বামীর কাছে অন্য কোন লোকের সম্পদের বাহুল্য তুলে ধরে ইত্যাদি। আপনাদের কারো মধ্যে যদি কোন কিছু নিয়ে হিংসা থেকে থাকে তাহলে একে অপরকে জানিয়ে দিন, যাতে সেই বিষয়গুলো দুজনই এড়িয়ে চলতে পারেন।
আসলে বিয়ের আগে এই বিষয়গুলো আলোচনা করার উদ্দেশ্য মানে বিয়ের প্রতি ভীতি তৈরী করা নয়। যেহেতু বিয়ে আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং কোন না কোন সময় প্রায় সবাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন, তাই এই নতুন জীবনটিকে সুন্দর করে তোলাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। একজন আরেকজনকে যতো ভালভাবে জানবেন সম্পর্কটা ততোই মধুর হবে।
লেখক: নীলা খানম
মনোবিজ্ঞান, ইডেন কলেজ

Comments